ট্রাফিক সংকেত এবং রোড সাইন – কোনটির অর্থ কী?
ট্রাফিক সাইন, রাস্তায় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন আদর্শ চালক হতে হলে অবশ্যই তাকে ট্রাফিক সাইনগুলো সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। আমাদের দেশে সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ ট্রাফিক সাইন সঠিক ভাবে না জানা ও মানা। আজ আপনাদের সাথে ট্রাফিক সাইন, ট্রাফিক সিগন্যাল, এবং রোড সাইন নিয়ে আলোচনা করব। অনেকেরই ধারনা ট্রাফিক সাইন, ট্রাফিক সিগন্যাল, রোড সাইন একি জিনিস। না তিনটিই আলাদা মার্ক।
প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের সকলকেই কম বেশি রাস্তায় চলাচল করতে হয়। নিজের ও অপরের জীবন এবং সম্পদ রক্ষার্থে জানা প্রয়োজন ট্রাফিক সাইন কি। ট্রাফিক পদ্ধতি নির্দেশনা বলতে ট্রাফিক চলার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতিকে বোঝায়, যেটা অনুসরণ করে সকল যানবাহন চলাচল করে।
রাস্তায় চলাচলের সময় যে কেউ যে কোন ধরনের আচরন করতে পারে। মূলত ট্রাফিক সাইন সমূহ রাস্তার পাশে বিভিন্ন প্রকার সম্পুরক প্লেট এর মধ্যমে নির্দেশ করে থাকে। চালক-যাএী-পথচারী আমরা সকলেই এই ট্রাফিক এর সাইন সমূহ মেনে চললে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।
রাস্তায় চলাচল করার সময় কেউ থাকে চালকের আসনে, কেউ যাত্রি, আবার কেউবা পথচারী। কিন্তু একটা বিষয়ে আমাদের সকলকেই সচেতন এবং সমান দায়িত্ব পালন করা উচিৎ, তা হল ট্রাফিক আইন। এ বিষয়ে আমাদের কাউকে অবহেলা করলে চলবে না। প্রত্যেককেই নিজের অবস্থান থেকে এই ট্রাফিক আইনগুলো মেনে চলতে হবে।
একজন সুনাগরিক হিসেবে আমাদের সকলেরই উচিৎ নিজ নিজ দেশের আইন কানুন মেনে গাড়ি চালানো। ট্রাফিক আইন বা সিগন্যাল একটা দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ আইন। কোন ধরণের তাড়াহুড়া বা আবেগের বশেও ট্রাফিক সিগনাল ভঙ্গ করা উচিৎ নয়। আপনি যদি ভেবে থাকেন সিগন্যাল না মেনে একটু আগে আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন তাহলে সেটা একটা ভুল ধারণা। কারন ট্রাইফ সিগন্যাল ভাঙলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়ে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে আরো বেশি দেরি হয়ে যেতে পারে।
ট্রাফিক সাইন কত প্রকার?
ট্রাফিক সাইন দু’প্রকার
– দৃশ্যমান সাইন ও অদৃশ্যমান সাইন।
- দৃশ্যমান সাইন বলতে যা আমরা চোখে দেখি তাকেই দৃশ্যমান সাইন বলে। যথাঃ ট্রাফিক পুলিশের সরাসরি সংকেত, ট্রাফিক লাইট সাইন, মোটরযানের বিভিন্ন ইন্ডেকেটিং লাইটিং সিস্টেম।
- অদৃশ্যমান সাইন বলতে যা আমরা দেখি না কিন্তু শুনতে পাই তাকেই অদৃশ্যমান সাইন বলে। যথাঃ মোটরযানের হরন।
ট্রাফিক সিগন্যাল বা সংকেত: ট্রাফিক সিগন্যাল বা সংকেত তিন প্রকার। যথাঃ (১) বাহুর সংকেত, (২) আলোক সংকেত, (৩) শব্দ সংকেত।
রোড সাইন কত প্রকার?
রোড সাইন তিন প্রকার। যথাঃ (১) বাধ্যতামূলক সাইন, (২) সতর্কীকরণ সাইন, (৩) তথ্যমূলক সাইন।
বাধ্যতামূলক দুই প্রকার। যথাঃ (১) বাধ্যতামূলক হ্যা বাচক, (২) বাধ্যতামূলক না বাচক।
আমরা রোড সাইন গুলোকে কিভাবে সহজে মনে রাখব
(১) বাধ্যতামূলক সাইন নিল বৃত্ত এবং লাল বৃত্তের মধ্যে হয়।
- নীলবৃত্ত মানে বাধ্যতামূলক হ্যা বাচক।
- লাল বৃত্ত মানে বাধ্যতামূলক না বাচক।
সুতরাং এককথায় বৃত্তের মধ্যে যে সাইন দেখব তাকে অবষ্যই বাধ্যতামূলক ধরব।
(২) সতর্কীকরণ সাইন ত্রিভুজ এর মধ্যে হয়ে থাকে।
(৩) তথ্যমূলক সাইন চতুর্ভুজ এর মধ্যে হয়ে থাকে।সুতরাং বৃত্ত, ত্রিভুজ, এবং চতুর্ভুজ এর মধ্যেই সাইন গুলো হয়ে থাকে।
ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানা
রাস্তায় বা মহাসড়কে চলাচলের সময়, অথবা রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করতে গেলে রাস্তার অনেক জায়গায় অনেক রকম সিগন্যাল এবং সাইন দেখা যায়। এসব সাইন এবং সিগনালগুলো পথচারী এবং চালকের জন্য নির্দেশক হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই কোথায় কীভাবে গাড়ি চালাতে হবে তা বুঝার জন্য, এইসব সিগন্যাল এবং সাইনগুলো সঠিকভাবে জানতে হবে এবং সেই অনুপাতে গাড়ি চালনা রপ্ত করতে হবে। এতে করে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
তথ্যমূলক সাইন আমাদেরকে রাস্তায় চলাচলের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এর ফলে রাস্তায় চলাচলের জন্য চালক-যাত্রী-পথচারী সকলের সুবিধা হয়। যেমন পার্কিং এর জন্য নির্ধারিত স্থান, ফিলিং স্টেশন, হাসপাতাল, পাবলিক টয়লেট, পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস, পথচারী পারাপার ইত্যাদি। আবার হাইওয়ে রোড়ে যে সকল সম্পুরক সম্পূরক নির্দেশনা প্লেট সমূহ থাকে সেগুলোও তথ্যমূলক সাইনের মধ্যে পরে। যেমন বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা গুলো হতে রাজধনী শহর ঢাকার দুরত্ব কতটুকু সেটার কিঃমিঃ এর তথ্য সরবরাহ করে থাকে। সেই সাথে যেসকল এলাকায় দুর্ঘটনার হার বেশী সেসকল এলাকায় দূর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় সম্পূরক সাইনবোর্ড দিয়ে আগাম নিদেশনা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সেনানিবাস ইত্যাদি এলাকার প্রবেশমুখে তথ্যমূলক সাইন থাকে।
এই সাইন সমূহ সাধারনত গোলাকার বৃত্তের মধ্যে থাকে। বাধ্যতামূলক সাইন যেহেতু দুই প্রকার তাই বাধ্যতামূলক না বাচক সাইন সমূহ লাল বৃত্তের মধ্যে থাকে এবং হ্যাঁ বাচক সাইন সমূহ গোল বৃত্তের মধ্যে সম্পুরক চিহ্ন সমূহ থাকে।
রাস্তায় না বাচক চিহ্ন থাকলে অবশ্যই সেটা করা যাবে না যেমন- ডানে / বামে মোড় নিষেধ, হর্ণ বাজানো নিষেধ, পাথচারী পারাপার নিষেধ, পাকিং ও ওভারটেকিং নিষেধ, সবোচ্চ গতিসীমা ও সর্বোচ্চ ওজনসীমা ইত্যাদি। হ্যাঁ বাচক চিহ্ন সমূহ ডানে/বামে মোড়, উভয় দিকে যাওয়ার দিক নির্দেশনা ও জাতীয় গতিসীমা প্রযোজ্য সাইন। অবশ্যই আমাদের রাস্তায় চলাচলের সময় সকলকে বাধ্যতামূলক হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক সাইন সমূহ মেনে চলতে হবে।
সর্তকতামূলক সাইন আমাদের রাস্তায় চলাচলের বিভিন্ন প্রকার সর্তকতার নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেমন ডানদিক থেকে আগত রাস্তা প্রধান সড়কে মিলিত হয়েছে সে ক্ষেএে চালককে অবশ্যই তার গাড়ির গতি কমিয়ে ডান পার্শের রাস্তায় আগত যানবাহনকে আগে যেতে দিতে হবে। এছাড়াও সামনে আকাবাঁকা রাস্তা, চৌরাস্তা, সামনে বাজার, স্কুল, গতিরোধক, জেব্রা ক্রসিং ও ট্রাফিক আলোর সংকেত ইত্যাদি আমাদেরকে সর্তকতা নির্দেশ করে থাকে।
ট্রাফিক সংকেত এবং রোড সাইন – একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের যা মেনে চলা উচিত
আপনি যদি একজন পথচারী হিসেবে মনে করেন ট্রাফিক আইন শুধুমাত্র গাড়ির চালকের মেনে চলা উচিত কিংবা চালক যদি মনে করে ট্রাফিক আইন আগে পথচারির মেনে চলা উচিত তাহলে উভয়েরই জীবনই ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।
একজন সুনাগরিক হিসেবে আপনার উচিৎ এমন ভাবে চলাফেরা করা যা অন্যদের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অনেকেই আছেন, যারা অনেকদিন ধরে গাড়ি ড্রাইভ করেন বিধায় মনে করেন তারা সব ট্রাফিক আইন এবং ড্রাইভিং নিয়ম জেনে বসে আছেন। এবং ফলশ্রুতিতে তারা মাঝে মাঝে এইসব ড্রাইভিং সেফটির কথাটি ভুলেও যান। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিৎ, রাস্তায় বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। মনে রাখবেন আপনি যখন আপনার সন্তান কিংবা পরিবারের কাউকে পাশে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করেন তখন তারা আপনাকে দেখেই শিখতে থাকে কীভাবে রাস্তায় সুনাগরিকের মতো গাড়ি চালাতে হয়।
গাড়ি চালানোর সময় চালকের করনীয়
আপনি কি একই সাথে গাড়ি ড্রাইভ, গান শোনা, আর ফোনে কথাবলা চালিয়ে যান? যদি এই অভ্যাস থেকে থাকে তাহলে আপনার উচিৎ অতি দ্রুতই এই অভ্যাস ত্যাগ করা। গাড়ি ড্রাইভ করার সময় মাল্টি টাস্কিং করলে আপনি যতটা না সুপারহিউম্যান হয়ে ওঠেন তার চাইতেও বেশি বিপদকে ডেকে আনেন। কারণ গাড়ি ড্রাইভিং এর সময় একাধিক কাজ একত্রে করলে তা আপনাকে মানসিকভাবে ড্রাইভ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এর ফলে শুধু যে আপনি নিজে বিপদের সম্মুখীন হবেন তা কিন্তু নয়, গাড়িতে থাকা আপনার পরিবারও বিপদের সম্মুখীন করে দিচ্ছেন।
- মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো
প্রতি বছর পৃথিবীতে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে মদ্যপান বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করা। বিশেষ করে যারা তরুণ তারা বুঝতেও পারেনা যে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করে তারা কীভাবে নিজের জীবনের মৃত্যু ডেকে আনছেন। নেশাজাত দ্রব্য একজন মানুষের মুডকে পরিবর্তন করে ফেলেন। এলকোহল মানুষকে উগ্র করে তোলে। ফলে একজন মদ্যপ যখন গাড়ি ড্রাইভ করেন তখন তিনি অনেক ট্রাফিক আইন না মেনেই নিজের মতো গাড়ি চালান। আর বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়েন।
- সঠিক স্থানে গাড়ি পার্কিং করা
সঠিক স্থানে গাড়ি পার্কিং না করার ফলে ঘটতে পারে নানা ধরনের সমস্যা। রাস্তায় অতরিক্ত য্যাম থেকে শুরু করে নান ধরনের সড়ক দূর্ঘটনা ঘটতে পারে আপনি যদি গাড়িটি সঠিক স্থানে না পার্কিং করেন। গাড়ি পার্কিং এর জন্য যে নির্দিষ্ট স্থান আছে চেষ্টা করতে হবে সেখানে পার্কিং করার জন্য। কখনই আপনি রাস্তার পাশে বা কোন মার্কেটের সামনে গাড়ি পার্কিং করবেন না।
- ফিটনেস বিহীন গাড়ি না চালানো
ফিটনেস বিহীন গাড়ি দূর্ঘটনার অন্যতম একটি প্রধান কারণ। আপনার গাড়ির যদি ব্রেক, চাকা, ইঞ্জিন ত্রুটিযুক্ত হয় তাহলে আপনার দূর্ঘটনা ঘটার চান্স তো এমনিতেই বেড়ে যাবে। এছাড়া ত্রুটিযুক্ত ইঞ্জিনের কারণে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয় যা সাধারণ লোকের সাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ বিষয়গুলো একজন চালকের খেয়াল রাখা উচিৎ।
- গাড়ির যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করা
গাড়ির যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে গাড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ত্রুটিযুক্র গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া কতটা ভয়ঙ্কর বিষয়! যখন তখন ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের একটা দূর্ঘটনা। এই জন্য একজন গাড়ি চালকের উচিৎ গাড়ির প্রাথমিক বিষয়গুলো পরীক্ষা করে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হওয়া।
- অতিরিক্ত গতি বর্জন করা
ওভার ট্র্যাকিং কিন্তু সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম একটি প্রধান কারণ। অনেকের ওভার ট্র্যাকিং করার একটি বাজে অভ্যাস থাকে, হ্যাঁ প্রয়োজনের তাগিদে ওভার ট্র্যাকিং হতে পারে কিন্তু সেইটা অবশ্যই ট্রাফিক আইন মেনে।
- পরিবারের সদস্যদের ট্রাফিক আইন শিক্ষা দেওয়া
আপনি একাই যদি ট্রাফিক আইন মেনে চলেন তাহলে কিন্তু নাগরিক হিসেবে আপনার সকল দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় নি। একজন সুনাগরিকের সমাজ এবং দেশের প্রতিও দায়বদ্ধতা থাকে। কেউ যদি ট্রাইক আইন না জানে তাকে ট্রাফিক আইন শিখিয়ে দেয়াও আপনার সামাজিক দায়িত্ব। আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এইসব দুর্ঘটনায় অনেক শিশু কিশোর হতাহত হয়ে থাকে। তাই তাদের এই হতাহতের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য তাদেরকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কিত জ্ঞান প্রদান করা দরকার ।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে সড়ক দূর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে আমরা নির্দিষ্ট কোন কিছুকে দায়ী করতে পারবো না। কিন্তু একটু দূর্ঘটনার কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে আপনার সব স্বপ্ন। কিন্তু আমরা সকলেই যদি প্রচলিত সকল ট্রাফিক আইন মেনে চলতে পারি, তাহলে এই সকল অপ্রত্যাশিত সড়ক দূর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা যাবে। সামান্য সতর্কতার ফলে আপনি একটি বড় বিপদ থেকে বেঁচে যেতে পারন।