মোটরসাইকেলের টায়ারের বিভিন্ন ধরণ এবং বাইক টায়ার কোড
মোটরবাইক মডিফাই করানোর ইচ্ছা থেকে হোক, কিংবা দুর্ঘটনার পর, অথবা কোনও রকম বড় কারণ ছাড়াই শুধু মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার মোটরসাইকেলের টায়ার একটা সময় ঠিকই বদলাতে হয়। দেশের বাজারে মোটরসাইকেল ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, একই ভাবে বাইক টায়ারের ক্ষেত্রেও এখন ব্যবহার ও গঠনের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের ডিজাইন ও মেয়াদের অপশন চলে এসেছে।
কিন্তু আমরা টিউব আর টিউবলেস টায়ার ছাড়া মোটরসাইকেলের টায়ারের আর কোনও প্রকারভেদ কি জানি? একই সাথে বাইক টায়ারের গায়ে যেই ছোট-বড় কোড লেখা থাকে, সেগুলো কি কখনো বোঝার চেষ্টা করেছি? আমাদের আজকের প্রতিবেদনটি মোটরসাইকেলের টায়ার এবং এর সাথে জড়িত যত ধরণের বিষয় আছে, সবকিছু নিয়ে তৈরি করেছি। আশা করি এটা আপনাদের কিছুটা হলেও উপকারে আসবে।
মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণ ও প্রকারভেদ
মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে বাইক টায়ার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে টিউব সহ কিংবা টিউবলেস টায়ার। যেকোন ধরণের মোটরসাইকেলের টায়ারকে এই দুই শ্রেণির মধ্যে ফেলা যায়। আমরা এই দুই শ্রেণির টায়ারের পার্থক্য জানার পাশাপাশি বিভিন্ন মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণ সম্পর্কে জানবো।
টিউব বনাম টিউবলেস টায়ার
পার্থক্যের বিষয় | টিউব টায়ার | টিউবলেস টায়ার |
জনপ্রিয়তা ও প্রচলন | অধিক প্রচলিত কিন্তু কম জনপ্রিয় | অধিক জনপ্রিয় কিন্তু কম প্রচলিত |
ওজন | ওজনে বেশি | ওজনে হালকা |
মাইলেজ দক্ষতা | ওজনে বেশি হওয়ায় মাইলেজ কম | ওজনে হালকা হওয়ায় মাইলেজ বেশি |
নিয়ন্ত্রণের সুবিধা | বাতাস কমে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। | বাতাসের চাপ হুট করে কমবেশি হয়না। তাই এতে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় নেই। |
ফুটো বা পাংচার মেরামত করা | টিউব টায়ারের পাংচার মেরামত করা বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ, পুরোটা খুলতে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের দেশের মেকানিকদের অভিজ্ঞতা বেশি আর সহজলভ্য। | টিউবলেস টায়ারের মেরামত করানো বেশ অল্প সময়ের ব্যাপার, টায়ার খুলতে হয় না। ছোট ফুটোর জন্য পাংচার কিট থাকলে নিজেই ঠিক করা যায়। দেশে এই ব্যাপারের অভিজ্ঞ মেকানিকের সংখ্যা কম। |
ফুটো হওয়ার পর বাইক চালানো | টিউব টায়ার পাংচার হলে বাইক চালানো যায় না, ঠেলে অথবা গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে হয়। | টায়ার পাংচার হলেও সেটিকে আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে নিরাপদ জায়গায় কিংবা মেকানিকের গ্যারেজে নিতে পারবেন। |
মেইনটেনেন্স খরচ ও দাম | টিউব টায়ার মেরামত করা কিংবা পরিবর্তন করা বেশ সাশ্রয়ী। দামও খুব একটা বেশি না। | টিউবলেস টায়ার মেরামত করা বা মেইন্টেনেন্স খরচ বেশি। তাছাড়া দাম বেশি তাই বদলানোর সময় খরচও বেশি। |
নিরাপত্তা | পাংচারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কম। হঠাৎ পাংচার হলে অনেক বাতাস বেরিয়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ হারায়। বাইক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি। | টায়ার পাংচার হলেও বেশ আস্তে আস্তে বাতাস বের হয়। ফলে হুট করে বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারানো বা দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি নেই। |
এরপর আমরা দেখবো মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণ অনুযায়ী প্রকারভেদ। ব্যবহার ও গঠনগত দিক থেকে মোটরসাইকেলের টায়ারকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে সেগুলো নিয়ে কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছিঃ
স্পোর্ট/ রেসিং মোটরসাইকেলের টায়ার
স্পোর্টস বা রেসিং টায়ারগুলো মূলত বেশ হালকা ওজনের এবং চওড়া প্রকৃতির হয়ে থাকে। এগুলো তুলমূলক গোলাকৃতির এবং চওড়া হওয়ায় হাই স্পিডে কর্ণারিং করতে বেশ সুবিধা হয়। এই টায়ারগুলোতে ট্রেড বা খাঁজের সংখ্যা অনেক কম থাকে, ফলে বেশি পরিমাণে ঘর্ষণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ভালো গ্রিপ পাওয়া যায়। অধিক তাপ সহ্য করা ও প্রসারিত হওয়ার জন্য এই বাইক টায়ারগুলোর পাশের অংশ অন্যান্য মোটরসাইকেলের টায়ারের চেয়ে বেশ নমনীয় উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় । কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এই টায়ারগুলো খুব দ্রুত ক্ষয় হয় এবং বারবার বদলানোর প্রয়োজন হয়।
সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশে রাস্তায় এই ধরণের টায়ার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের রাস্তার সাথে এই টায়ারগুলো খাপও খায় না। তাই সখের বশেও কখনও এই টায়ার ব্যবহার করার চেষ্টা করলে মোটরসাইকেল জরিমানা দিতে হবে।
রোড/ ট্যুরিং মোটরসাইকেলের টায়ার
ট্যুরিং টায়ারগুলোতে স্পোর্ট টায়ারের মত ভালো ঘর্ষন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, কিন্তু স্পোর্ট বাইক টায়ারের তুলনায় এদের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। সোজা রাস্তায় ভালো পারফরম্যান্স পাওয়ার জন্য এই মোটরসাইকেলের টায়ারগুলো কিছুটা সোজা আকৃতির হয়ে থাকে। তাপমাত্রা সহনীয়তায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে এই টায়ারগুলোতে স্পিড লিমিট থাকে।
সাধারণত ট্যুরিং বাইক টায়ারগুলো কিছুটা মজবুত ও শক্ত উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। ফলে এদের গ্রিপ স্পোর্ট টায়ারের তুলনায় কিছুটা কম হলেও ট্যুরিং মোটরসাইকেলের টায়ারের স্থায়িত্বকাল এবং রেঞ্জ বেশ ভালো হয়। ভেজা রাস্তায় এবং বৃষ্টিতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় এই টায়ারগুলো বেশ ভালো কাজ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেলে লং ট্যুর দেয়ার জন্য এই টায়ারগুলো সবার পছন্দের তালিকায় উপরে থাকে।
স্পোর্ট ট্যুরিং মোটরসাইকেলের টায়ার
এই বাইক টায়ারগুলো স্পোর্ট টায়ার এবং ট্যুরিং টায়ার দু’টোর মাঝামাঝি মানের হয়ে থাকে। মধ্যম মাত্রার নমনিয় রাবার দিয়ে তৈরি এই টায়ারগুলো আপনি চাইলে স্পোর্টস বাইকেও ব্যবহার করতে পারবেন, আবার টুরিং বাইকেও ব্যবহার করতে পারবেন।
ক্রুজার মোটরসাইকেলের টায়ার
ক্রুজার এবং ট্যুরিং বাইক টায়ারের মধ্যে বড় তফাত হচ্ছে ট্যুরিং মোটরসাইকেলগুলো ক্রুজারের তুলনায় বেশ ভালো কর্ণারিং করতে পারে। এই টায়ারগুলো শক্ত উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ায় বেশ ভারী ওজন বহন করার ক্ষমতা রাখে, আবার একই সাথে ভালো মাইলেজও পাওয়া যায়। মাইলেজ বেশি পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে এদের খাঁজের পুরুত্ব এবং শক্ত উপাদানের দারুণ সমন্বয়। একই কারণে এই টায়ারগুলো ক্ষয় হতে সময় লাগে এবং ওজনও একটু বেশি হয়।
অফ-রোড মোটরসাইকেলের টায়ার
বাংলাদেশের যেসব এলাকায় পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা নেই, সেসব নরম মাটি ও পাথুরে রাস্তার জন্য অফ-রোড বাইক টায়ার বেশ ভালো কাজ করে। মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণ যত রকম রয়েছে, তার মধ্যে এই টায়ারের বিক্রি আমাদের দেশে সবচেয়ে কম। কেননা আমাদের দেশের রাস্তা কোনও জায়গাতেই টানা একরকম থাকে না। আবার সব রাইডাররা একাধিক ধরণের টায়ার রাখা এবং বদল করার মত অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য রাখেন না।
মিক্সড ট্রেইল মোটরসাইকেলের টায়ার
এই ধরণের টায়ার পিচ ঢালা রাস্তা এবং মাটির অসমতল রাস্তা দুই ক্ষেত্রেই সমানভাবে কার্যকর। এই মোটরসাইকেল টায়ারের ধরণের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের বড় ফাঁকযুক্ত খাঁজ। কিছুটা ব্লকের মতো আকৃতির হওয়ায় নরম মাটিতে বেশ ভালো গ্রিপ পাওয়া যায়। শক্ত রাবার জাতীয় উপাদান দিয়ে তৈরি এই টায়ারের তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা একটু কম হলেও, স্থায়িত্ব অনেক বেশী হয়।
এই মোটরসাইকেলের টায়ার বড় গ্রিপের কারণে পৃষ্ঠতল কমে যাওয়ায় পিচ ঢালা অথবা সমতল রাস্তায় গ্রিপ একটু কম হয়। কাঁচা রাস্তা এবং পিচ ঢালা উভয় রাস্তাতেই যাদের বাইক চালাতে হয়, বিশেষ করে গ্রাম কিংবা মফস্বল অঞ্চলের বাইকারদের জন্য এই টায়ার বেশ কাজের।
মোটরসাইকেলের টায়ার কোড
বাইক টায়ারের গায়ে ছোট বড় বিভিন্ন রকম কোড ও নির্দেশনা দেয়া থাকে, যেগুলো দেখে আপনি নিজেই টায়ার সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন। আমার টায়ারের গায়ে যেসব কোড আছে, সেগুলোকে উদাহরণ ধরে মোটরসাইকেলের টায়ার কোড এবং সেগুলোর অর্থ নিচে উল্লেখ করছিঃ
প্রথমেই বাইক টায়ারের পাশে দেখা যায় 110/80-17 এই ধরণের একটি কোড। এই কোড দ্বারা মোটরসাইকেলের টায়ারের সাইজ উল্লেখ করা হয়। এখানে প্রথম সংখ্যাটার মানে হচ্ছে টায়ারের প্রস্থ ১১০ মিলিমিটার। স্ল্যাশ(/) এর পরের অংশটি হচ্ছে টায়ারের উচ্চতা, যা আমার বাইকের ক্ষেত্রে ১১০ মিলিমিটারের ৮০%। এর পর ড্যাশ(–) এর পরের সংখ্যা দিয়ে রীমের ব্যাস বোঝানো হয়, আমার টায়ার রীমের ব্যাস ১৭ ইঞ্চি।
এর পাশেই রয়েছে 57P। P হচ্ছে প্যাসকেল, অর্থাৎ চাপের একক। কারো কারো বাইকে KP অর্থাৎ কিলোপ্যাসকেল এককে বাইক টায়ার প্রেশার উল্লেখ করা থাকে।
টায়ারের উচ্চতার বর্ডার বরাবর TWI↑ এই চিহ্নটি দেয়া থাকে। এই চিহ্ন আপনার টায়ারের ক্ষয় কতটুকু হয়েছে সেটা বুঝতে সাহায্য করে। ‘↑’ চিহ্নটির সাথে টায়ারের বর্ডার মিলে গেলে বুঝতে হবে আপনার টায়ার পরিবর্তনের সময় এসে গেছে।
এরপর কিছুটা ছোট অক্ষরে বাইকের MAX SPEED এবং MAX LOAD লেখা আছে। আমার বাইক টায়ারের সর্বোচ্চ স্পিড ধারণ ক্ষমতা ১৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা, এবং সর্বোচ্চ লোড সীমা ২৩০ কেজি। এই সীমাগুলো অতিক্রম হলে টায়ারের সমস্যা হতে পারে এবং ফেটে যাওয়ার বা পাংচার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর আমার মোটরসাইকেলের টায়ারের গায়ে ১০ ডিজিটের একটা সংখ্যা হাইলাইট করে দেয়া রয়েছে। এই সংখ্যার শেষের চারটি ডিজিট 3220 আমার টায়ারের উৎপাদনের সময় বলে দিচ্ছে। শেষ দু’টি ডিজিট হচ্ছে উৎপাদনের সাল অর্থাৎ ২০২০, এবং তার আগের দু’টি ডিজিট হচ্ছে সপ্তাহ অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩২তম সপ্তাহে এটি উৎপাদন করা হয়েছিল। এই ১০ ডিজিটের সংখ্যাটি দেখে আপনি আপনার বাইক টায়ারের মেয়াদ আর কতদিন আছে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবেন এবং মেয়াদ-উত্তীর্ণ টায়ার কেনার হাত থেকেও বেঁচে যাবেন।