পুরাতন মোটরবাইক কেনার ক্ষেত্রে কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
সময়ের প্রয়োজনে আমরা অনেকেই পুরাতন মোটরবাইক কেনার কথা বিবেচনা করে থাকি। ব্যস্ত সড়কের যানযট এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার চায় সাধ্যের মাঝে একটি পুরাতন বা সেকেন্ডহ্যান্ড মোটরবাইক কিনতে। পুরাতন মোটরসাইকেলের দাম তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায়, সাময়িক ব্যবহারের জন্য এটিই অনেকের প্রথম পছন্দ হয়ে থাকে। কিন্তু একটি পুরাতন মোটরবাইক কেনার সময় কোন কোন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয় একজন বাইকারের? কেবল বাইকের বাহিরের লুকই সব কথা বলে, নাকি মোটরবাইকের পারফরম্যান্স কেমন সেটাও বিবেচনার বিষয় হতে পারে? চলুন আজ জেনে নেই সেই বিষয়গুলো।
বাইকের পরিচ্ছন্নতা
পুরাতন মোটরবাইক এর পূর্ববর্তী মালিক বাইকের যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন কিনা তা বুঝা যায় বাইকের পরিচ্ছন্নতা দেখলে। বাইকের গায়ে কোনো প্রকার স্ক্র্যাচ বা রঙ উঠে যাওয়া আছে কিনা তা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন। সেই সাথে বাইকের যেসকল অংশে সচরাচর ময়লা আটকায় কিন্তু পরিষ্কার করা কঠিন, সেসকল অংশ সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন যে পুরাতন মোটরবাইক কেবল বিক্রির জন্য তাড়াহুড়ো করে পরিষ্কার করা হয়েছে নাকি যত্ন সহকারে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হচ্ছে।
যারা বাইক অযত্নে রাখেন, তাদের পরিষ্কারের ধরন দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে তারা বাইকটি কেবল বিক্রির উদ্দেশ্যে কোনোরকমে পরিষ্কার করে রেখেছেন। তারা বাইকের তেমন যত্ন নেন নি। একজন যত্নশীল বাইকার সবসময় তার বাইক পরিষ্কার করে রাখেন। তাতে যত সময়ই লাগুক না কেন, তিনি কোনো কার্পন্য করেন না।
এক্সহস্ট পাইপ
পুরাতন মোটরবাইক পর্যবেক্ষণের শুরুতেই এক্সহস্ট পাইপের পরিস্থিতি দেখা জরুরি। আর এজন্য বাইকের ইঞ্জিন চালু না করে, এক্সহস্ট ঠান্ডা থাকা অবস্থায় এর অবস্থা লক্ষ্য করবেন। খেয়াল করুন এক্সহস্ট পাইপ ঠিকমতো লাগানো আছে কিনা বাইকের বডির সাথে। ইঞ্জিন চালু করলে ভাইব্রেশনের কারণে দূর্বল এক্সহস্ট পাইপ খুলে পড়তে পারে। এজন্য বাইক দেখতে যাওয়ার আগেই বলে রাখুন বাইকের ইঞ্জিন যাতে অফ থাকে, ফলে বাইকের এক্সহস্ট ঠান্ডা থাকা অবস্থায় আপনি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
ফ্রেম
এবার দেখুন বাইকের ফ্রেমে কোনো প্রকার দাগ বা ঘষার চিহ্ন আছে কিনা। পুরো ফ্রেমে হাত বুলিয়ে দেখুন এটি মসৃণ কিনা। বাইকের ফ্রেমে কোনো দাগ থাকলে সেটি আপনার হাতে লাগবে। সেই সাথে দেখুন স্টিয়ারিং হেড ঠিক আছে কিনা। ফ্রন্ট ব্রেক ধরে রেখে বাইকটি সামনে পিছে করে দেখুন। যদি কোনো নড়াচড়া বা ক্লিকিং সাউন্ড পান, তাহলে স্টিয়ারিং হেডের বিয়ারিং পরিবর্তন করা লাগতে পারে।
ক্লাচ
পুরাতন বাইকের ফিচার দেখতে ক্লাচ স্মুথ সাপোর্ট দিচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করুন। ক্লাচ হালকা করে ধরে ছেড়ে দিন। যদি ক্লাচটি সাবলীলভাবে ছেড়ে আসে, তাহলে বুঝবেন তেমন কোন সমস্যা নেই। তবে ক্লাচ যদি নিজ থেকে কিছুক্ষণ ধরে রেখে তারপর ছাড়ে, তাহলে ক্লাচে সমস্যা আছে যা সমাধান করতে হবে। বাইকে বসে প্রথম গিয়ারে ধাক্কা দিয়ে দেখুন। সব ঠিক থাকলে হালকা বাঁধা দিয়ে বাইক সামনে এগিয়ে যাবে।
ব্রেক ও সাসপেনশন
বাইকটি সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে হালকা এগিয়ে ফ্রন্ট ব্রেক চাপুন। ব্রেক প্যাড ভালো হলে কোনো প্রকার শব্দ বা বাঁধা ছাড়াই বাইক গতি কমিয়ে ফেলবে। এবার ব্রেক হালকা করে ছাড়ুন। দেখুন বাইক নিজ থেকে সামনে এগুচ্ছে কিনা। হালকা গতিতে বাইক চালিয়ে দেখুন ব্রেকিং নিয়ে কোন বাঁধার মুখে পড়ছেন কিনা।
একইভাবে পুরাতন বাইকের ফিচার হিসেবে সাসপেনশন থেকে কোন শব্দ আসছে কিনা খেয়াল করুন। যদি সাসপেনশন ফর্কে মরিচা ধরে থাকে, তবে তাতে বেশ ভালো মানের মেরামতের প্রয়োজন পড়বে। একটি ভালো মানের ফর্ক দেখতে পরিষ্কার, উজ্জ্বল এবং স্মুথ হবে। সেই সাথে এর বাউন্সও হবে বেশ সাবলীল।
চেইন এবং স্প্রোকেট
মোটরবাইক এর চেইন যেই অংশের সাথে লাগানো থাকে, তাকে বলে স্পোকেট। খেয়াল করুন চেইনের উপর কোনো মরিচা বা ময়লা আটকে আছে কিনা। ভালো মানের চেইন অবশ্যই পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল দেখতে হবে। আর স্প্রোকেট দাঁতগুলো লক্ষ্য করুন। এগুলো যদি বাঁকানো থাকে বা ক্ষয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এর অবশ্যই মেরামতের প্রয়োজন পড়বে।
টায়ার এবং হুইল
বাইকের টায়ারে কোনো প্রকার বার্নআউটের চিহ্ন দেখলে বুঝতে হবে বাইকের পারফরম্যান্স ভালো হবে না। বার্নআউট করা বাইকের টায়ারের পাশাপাশি এর ইঞ্জিনের জন্যও বেশ ক্ষতিকর। তাই খেয়াল করবেন আপনার বাইকের টায়ার স্মুথ আছে কিনা। টায়ারের মেয়াদ চেক করার জন্য এর গায়ে থাকা চার ডিজিটের কোডটি দেখুন। প্রথম দুই ডিজিট হলো কোন সপ্তাহে টায়ারটি বানানো হয়েছে এবং শেষের দুই ডিজিট হলো সালের সংখ্যা। অভিজ্ঞদের পরামর্শ মতে, যদি ছয় বছরের পুরনো টায়ার হয়ে থাকে, তাহলে টায়ারের কন্ডিশন নতুন হলেও তা পরিবর্তন করা জরুরি। আর হুইল পর্যবেক্ষনে খেয়াল করবেন কোনো প্রকার মরিচা বা ক্ষয়ে যাওয়া অংশ আছে কিনা। সেই সাথে কোনো বেঁকে যাওয়া অংশ থাকলে তা অবশ্যই মেরামত করতে হবে।
ফুয়েল ট্যাঙ্ক
ফুয়েল ট্যাঙ্ক সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরাতন বাইকের ফিচার দেখার জন্য একটি ছোট ফ্ল্যাশ লাইট সাথে নিয়ে যাবেন। ভিতরে পরিষ্কার ফুয়েল থাকলে, লাইট দেয়ার পর অ্যাম্বার কালার দেখতে পাবেন। সেই সাথে ফুয়েল ট্যাঙ্কের ভিতরের মেটালও পরিষ্কার দেখতে পাবেন। যদি কালো ফুয়েল দেখেন, তাহলে বুঝতে ফুয়েলটি পুরনো এবং তা সাথে সাথেই পরিবর্তন করতে হবে। সেই সাথে ফুয়েলে কোনো ময়লা আছে কিনা তা বুঝার জন্য বাইকটি হালকা নাড়া দিন। যদি ভারী কোনো ময়লা থাকে, তাহলে সেটিকে ভাসতে দেখা যাবে।
তেলের ট্যাঙ্ক
বাইকের তেল নিরীক্ষণের জন্য একটি কাঠি নিন তেলের ট্যাঙ্কের ভিতর চুবানোর জন্য। যদি তেল পরিষ্কার হয়, তাহলে এটি ট্রান্সপারেন্ট সিরাপের মতো দেখা যাবে। তবে যদি কালো ভাব দেখা যায় কিংবা ভিতরে তেল ঘন হয়ে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই ফেলে দিতে হবে। তা না হলে মোটরবাইকের পারফরম্যান্স আশানুরূপ পাবেন না।
কোল্ড স্টার্ট
সবশেষে বাইক চালু করে দেখুন এর শব্দ কীরকম। একেকটি বাইকের ভিন্ন রকম শব্দ থাকে। আগে থেকে জেনে নিন কিক স্টার্ট দিতে হলে কি পরিমাণ থ্রটল দেয়া লাগে। বাইকের ইঞ্জিন পুরোপুরি চালু করার আগে ওয়ার্ম আপ করিয়ে নিন। ইঞ্জিন স্টার্ট নিলে দেখুন কোনো ধোঁয়া বের হচ্ছে কিনা। সচরাচর কমিউটার বাইকগুলো থেকে কোনো ধোঁয়া বের হয় না। ধোঁয়া দেখলে তেল এবং ফুয়েলের মিক্স পরীক্ষা করুন। সেই সাথে মোটরবাইকের পারফরম্যান্স ঠিকভাবে দেখার আগে স্পার্ক প্লাগ পরীক্ষা করে দেখুন।
ইলেক্ট্রিক্যাল
বাইকের সকল ইলেক্ট্রিক্যাল ফিচার ঠিকমতো কাজ করছে কিনা দেখুন। হাই বিম এবং লো বিমে হেড লাইট পরীক্ষা করুন। ইন্ডিকেটর লাইট এবং টেইল লাইট দেখুন। সেইসাথে কনসোল প্যানেলের অন্যান্য সকল ফিচার পরীক্ষা করে দেখুন।
ব্যাকগ্রাউন্ড এবং রেজিস্ট্রেশন
পুরাতন মোটরসাইকেলের দাম নিয়ে পূর্ববর্তী মালিকের সাথে কথা বলে এর পূর্বে কোনো দূর্ঘটনার ইতিহাস আছে কিনা অথবা অন্যান্য সার্ভিসিং রেকর্ড যা আছে তা জেনে নিন। এজন্য অভিজ্ঞ কাউকে অবশ্যই সাথে নিয়ে যাবেন। আর বাইকের রেজিস্ট্রেশনের সকল কাগজপত্র পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি প্রকৃত মালিকের নিকট থেকেই বাইকটি কিনছেন।
পুরাতন বাইক কেনা সবসময়ই বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া কারণ এতে বাইকের সকল পার্টসই খুবই সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। খেয়াল রাখবেন পুরাতন মোটরসাইকেলের দাম ঠিক করার সময় কোনোভাবেই যেন আপনি প্রতারণার শিকার না হন। বাইক প্রকৃত মালিকের থেকে কিনবেন এবং কেনার সময় কাগজপত্র ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত। আর বাইকের সকল খুঁটিনাটির ব্যাপারে অভিজ্ঞ এমন কাউকে অবশ্যই সাথে নিয়ে যাওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
যেকোনো বাইক বা স্কুটার রিভিউ, স্পেসিফিকেশন, ফিচারস এবং বাইক সম্পর্কিত আরো বিভিন্ন তথ্য পেতে ভিজিট করুন বাইকস গাইড। বাংলাদেশে বিভিন্ন বাইক বা স্কুটার এবং নতুন বা ব্যবহৃত মোটরবাইকের দাম জানতে হলে চোখ রাখুন দেশের সেরা মোটরবাইক মার্কেটপ্লেস Bikroy-এ।
পুরাতন মোটরবাইক সম্পর্কিত জিজ্ঞাসা
১। বাইকের তেল পরীক্ষা করবো কিভাবে?
উত্তর – বাইকের তেল নিরীক্ষণের জন্য একটি কাঠি নিন তেলের ট্যাঙ্কের ভিতর চুবানোর জন্য। যদি তেল পরিষ্কার হয়, তাহলে এটি ট্রান্সপারেন্ট সিরাপের মতো দেখা যাবে। তবে যদি কালো ভাব দেখা যায় কিংবা ভিতরে তেল ঘন হয়ে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
২। বাইকের চেইন পরীক্ষা করবো কিভাবে?
উত্তর – খেয়াল করুন চেইনের উপর কোনো মরিচা বা ময়লা আটকে আছে কিনা। ভালো মানের চেইন অবশ্যই পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল দেখতে হবে। আর স্প্রোকেটের দাঁতগুলো লক্ষ্য করুন। এগুলো যদি বাঁকানো থাকে বা ক্ষয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এর অবশ্যই মেরামতের প্রয়োজন পড়বে।
৩। বাইকের বডি চেক করার নিয়ম কী?
উত্তর – পুরো ফ্রেমে হাত বুলিয়ে দেখুন এটি মসৃণ কিনা। বাইকের ফ্রেমে কোনো দাগ থাকলে সেটি আপনার হাতে লাগবে। সেই সাথে দেখুন স্টিয়ারিং হেড ঠিক আছে কিনা। ফ্রন্ট ব্রেক ধরে রেখে বাইকটি সামনে পিছে করে দেখুন। যদি কোনো নড়াচড়া বা ক্লিকিং সাউন্ড পান, তাহলে স্টিয়ারিং হেডের বিয়ারিং পরিবর্তন করা লাগতে পারে।